তোমরা ইতিমধ্যে জেনে গেছ সব পদার্থ অণু দিয়ে তৈরি এবং কঠিন পদার্থে অণুগুলো নির্দিষ্ট অবস্থানে থেকে একে অন্যকে আটকে রাখে। তাপ দেওয়া হলে এগুলোর কম্পন বেড়ে যায় এবং আণবিক বন্ধন শিথিল হয়ে একে অন্যের ওপরট গড়াগড়ি খেয়ে নড়তে শুরু করে এবং এটাকে আমরা ৰলি তৱল। তাপমাত্রা যদি আরো বেড়ে যায় তখন অণুগুলো মুক্ত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে, তাকে আমরা বলি গ্যাস। এই ব্যাপারটি আমরা এখন আরেকটু গভীরভাবে দেখব এবং পদার্থের অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সম্পর্ক আছে এ রকম বিভিন্ন রাশির সাথে পরিচিত হব।
একটা কঠিন পদার্থকে যখন তাপ দেওয়া হয় তখন তার তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। (কী হারে তাপমাত্রা বাড়বে এবং সেটা কিসের ওপর নির্ভর করে সেটা আমরা একটু পরেই জেনে যাব।) তাপমাত্রা (একটা নির্দিষ্ট চাপে) একটা নির্দিষ্ট মানে পৌঁছালে কঠিন পদার্থটি পলতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়াটার নাম গলন এবং যে তাপমাত্রায় গলন শুরু হয় সেটাকে বলে গলনাঙ্ক । আমরা যদি কঠিন পদার্থের তাপমাত্রা মাপতে থাকি তাহলে একটু অবাক হয়ে লক্ষ করব যখন পলন শুরু হয়েছে তখন তাপ দেওয়া সত্ত্বেও খানিকটা কঠিন খানিকটা তরলের এই মিশ্রণের তাপমাত্রা আর বাড়ছে না,এই সময়টিতে তাপ কঠিন পদার্থের অণুগুলোর ভেতরকার আন্তঃআণবিক বন্ধনকে শিথিল করতে ব্যয় হয়। তাই অণুগুলোকে আরো গতিশীল করতে পারে না বলে তাপমাত্রা বাড়তে পারে না। গলন চলাকালীন নির্দিষ্ট গলনাঙ্কে যে পরিমাণ তাপ দিয়ে পুরো কঠিন পদার্থকে তরলে রূপান্তর করতে হয় সেই ভাগকে বলা হয় গলনের সুপ্ততাপ।
একবার পুরো কঠিন পদার্থটি তরলে রূপান্তরিত হওয়ার পর তাপমাত্রা আবার বাড়তে শুরু করে তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে এক সময় তরল পদার্থটি গ্যাসে পরিবর্তন হতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়াটির নাম বাষ্পীভবন এবং যে তাপমাত্রায় বাষ্পীভবন ঘটে সেটাকে বলে স্ফুটনাঙ্ক। আবার সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে এই স্ফুটনাঙ্ক চাপের ওপর নির্ভর করে।
যখন বাষ্পীভবন প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন তরলের অণুগুলো তাপশক্তি নিয়ে পরস্পরের সাথে যে আণবিক বন্ধন আছে সেটা থেকে যুক্ত হতে শুরু করে। গলনের মতো এখানেও যদিও তাপ দেওয়া হয়, তাতে তরলের তাপমাত্রা কিন্তু বাড়ে না। তরলকে বাষ্পীভূত করার সময় যে পরিমাণ তাপ দিয়ে পুরো তরল পদার্থকে গ্যাসে পরিণত করা হয় সেই তাপকে বলা হয় বাষ্পীভবনের সুপ্ততাপ। পুরো তরলটা প্যাসে রূপান্তর করার পর তাপ দিতে থাকলে গ্যাসের তাপমাত্রা আবার বাড়তে থাকে। তাপমাত্রা মোটামুটি অচিন্তনীয় পর্যায়ে নিতে পারলে অণুগুলো আয়নিত হতে শুরু করবে এবং প্লাজমা নামে পদার্থের চতুর্থ অবস্থা শুরু হবে, কিন্তু সেটি অন্য ব্যাপার।
তাপ দিয়ে কঠিন থেকে তরল এবং তরল থেকে প্যাসে রূপান্তরের এই প্রক্রিয়ার অন্তত একটি উদাহরণ আমরা সবাই দেখেছি, সেটি হচ্ছে বরফ, পানি এবং বাষ্প। আমরা যদিও সরাসরি গলনের সুপ্ততাপ কিংবা বাষ্পীভবনের সুপ্ততাপ দেখি না। কিন্তু তার একটা প্রভাব অনেক সময় অনুভব করেছি। অনেক ভিড়ে কিংবা আবদ্ধ জায়গায় গরমে ছটফট করে আমরা যদি হঠাৎ খোলা জায়গায় কিংবা বাতাসে আসি তখন শরীর শীতল হয়ে জুড়িয়ে যায়। তার কারণ খোলা জায়গায় আসার পর শরীর থেকে ঘাম বাষ্পীভূত হওয়ার সময় বাষ্পীভবনের সুপ্ততাপটুকু শরীর থেকে নিয়ে নেয়। এবং শরীরটাকে শীতল করে দেয়।
তাপ দিয়ে কঠিন থেকে তরল, তরল থেকে গ্যাসে যে রকম রূপান্তর করা হয় তার উল্টো প্রক্রিয়াটিও কিন্তু ঘটে। ভাগ সরিয়ে নিলে একটা গ্যাস প্রথমে তরল, তারপর কঠিন হতে পারে। বায়বীয় অবস্থা থেকে তরল অবস্থায় রূপান্তরিত হওয়াকে ঘনীভবন (Liquification) বলে। তরল অবস্থা থেকে কঠিন অবস্থায় রূপান্তরিত হওয়াকে কঠিনীভবন (Solidification) বলে।
আমরা পদার্থের অবস্থানের পরিবর্তনের সময় বলেছি কঠিন থেকে তরল কিংবা তরল থেকে গ্যাসে রূপান্তরের জন্য একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় পৌঁছাতে হয়। কিন্তু সেই তাপমাত্রায় না পৌঁছেও কিন্তু কঠিন থেকে তরল, তরল থেকে গ্যাস কিংবা সরাসরি কঠিন থেকে গ্যাসে রূপান্তর হতে পারে। আমরা যদি পদার্থের আণবিক মডেলে ফিরে যাই তাহলে বিষয়টা বোঝা মোটেও কঠিন নয়। একটা অণু যদি কোনোভাবে যথেষ্ট শক্তি পেয়ে যায় এবং তার কারণে যদি তার গতিশক্তি যথেষ্ট বেড়ে যায় যে সেটি কঠিন পদার্থ কিংবা তরল পদার্থের পৃষ্ঠদেশ থেকে বের হয়ে আসতে পারে। কঠিন কিংবা তরলের পৃষ্ঠদেশে যেহেতু বাইরের বাতাস থেকে অসংখ্য অণু ক্রমাগত আঘাত করছে তাই তাদের আঘাতে কখনো কখনো কঠিন কিংবা তরলের কোনো কোনো অণু মুক্ত হয়ে যাবার মতো শক্তি পেয়ে যেতে পারে। তাই পৃষ্ঠদেশ যত বিস্তৃত হবে এই প্রক্রিয়াটি তত বেশি কাজ করবে। আমরা সবাই এই প্রক্রিয়াটি দেখেছি একটা ভেজা জিনিস এমনিতেই শুকিয়ে যায় এর জন্য এটাকে স্ফুটনাঙ্কের তাপমাত্রায় নিতে হয় না। শুকিয়ে যাওয়া মানেই তরল পদার্থের অণুর বাষ্পায়িত হয়ে যাওয়া। যেকোনো তাপমাত্রায় এই প্রক্রিয়া ঘটতে পারে এবং এই প্রক্রিয়াটার নাম বাষ্পায়ন (Evaporation)।
পানির বাষ্পায়নের সময় পানি যে রকম তার বাষ্পীভবনের সুপ্ততাপটুকু নিয়ে নেয়, এর উল্টোটাও সত্যি। যদি কোনো প্রক্রিয়ায় বাষ্প পানিতে রূপান্তরিত হয় তখন সেটি তাপ সরবরাহ করে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় সমুদ্রের জলীয় বাষ্পে ভরা বাতাস উপরে উঠে যখন জলকণায় রূপান্তরিত হয় তখন বাষ্পীভবনের সুপ্ততাপটা শক্তি হিসেবে বের হয়ে আসে। এই শক্তিটা ঘূর্ণিঝড়ের প্রচণ্ড শক্তি হিসেবে কাজ করে।
তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ বর্ষাকালের বৃষ্টিভেজা দিনগুলোতে ভেজা কাপড় কিছুতেই শুকাতে চায় না। আবার শীতকালে ঘরের ভেতর ছায়াতেও একটা কাপড় ধুয়ে শুকাতে দিলে সেটি শুকিয়ে যায়। কাপড় ধুয়ে শুকাতে দিলে সব সময় কাপড়টি ভালো করে মেলে দিতে হয়, ভেজা কাপড় ভাঁজ হয়ে থাকলে সেই জায়গাটুকু ভেজা থেকে যায়। ভেজা কাপড় শুকানোর বিষয়টি পানির বাষ্পায়ন ছাড়া আর কিছু না, কাজেই তোমরা দেখতেই পাচ্ছ পানির বাষ্পায়ন বেশ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে। সত্যি কথা বলতে কি পানির জন্য যেটা সত্যি অন্যান্য তরলের বেলাতেও সেটা সত্যি, তাই আমরা সাধারণভাবেই একটা তরলের বাষ্পায়ন কোন কোন বিষয়ের উপর নির্ভর করে তার একটা তালিকা করতে পারি:
বাতাসের প্রবাহ: বাতাসের প্রবাহ বেশি হলে বাষ্পায়ন বেশি হয়।
তরলের উপরিভাগের ক্ষেত্রফল: তরলের উপরিভাগের ক্ষেত্রফল যত বেশি হবে বাষ্পায়ন তত বেশি হবে। এক গ্লাস পানি বাষ্পীভূত হতে অনেক সময় নেবে কিন্তু সেই পানিটা বড় থালায় ঢেলে দিলে অনেক তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে।
তরলের প্রকৃতি: তরলের স্ফুটনাঙ্ক কম হলে বাষ্পায়ন বেশি। উদ্বায়ী তরলের বাষ্পায়ন সবচেয়ে বেশি।
বাতাসের চাপ: বাতাসের চাপ যত কম হবে বাষ্পায়নের হার তত বেশি। শূন্যস্থানে বাষ্পায়ন সবচেয়ে বেশি, তাই খাদ্য সংরক্ষণের জন্য খাবারকে শুকাতে পাম্প দিয়ে বাতাস বের করে নেওয়া হয়।
উষ্ণতা: তরল এবং তরলের কাছাকাছি বাতাসের উষ্ণতা বেশি হলে বাষ্পায়ন বেশি হয়।
বায়ুর শুষ্কতা: বাতাস যত শুষ্ক হবে তরল তত তাড়াতাড়ি বাষ্পায়ন হবে।
আরও দেখুন...